মানব চিত্র ডেস্ক : ডিজিটাল ডিভাইস তথা মোবাইল, কম্পিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার যেনো আমাদের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে গেছে। ডিজিটাল ডিভাইস এর প্রকৃত নিরাপত্তা, ব্যবহারবিধি না জেনেই অজ্ঞতা বা অসচেতনতা বশতঃ কিংবা নিছক কৌতূহলবশতঃ অনেকেই তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করতে গিয়ে বিপদে পড়ছেন। প্রতিনিয়ত হয়রানীর শিকার হচ্ছেন অসংখ্য মানুষ।
বিশেষ করে বাংলাদেশে জনপ্রিয় সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম- Facebook, WhatsApp, Imo, Instagram, Telegram, Viber, মেসেঞ্জার সহ অন্যান্য অডিও, ভিডিও যোগাযোগ মাধ্যমের ব্যবহার প্রতিনিয়ত বেড়েই চলেছে।
দেশে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ার সাথে সাথে সমান হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সহিংসতা, উগ্রবাদ, গুজব ছড়ানো, রাজনৈতিক অপপ্রচার, ফেক-নিউজ, গ্যাং কালচার, আত্মহত্যা, পর্ণগ্রাফি, সাইবার বুলিং, চাঁদাবাজী, জাল-জালিয়াতি, পাইরেসি, আসক্তি এসবই হচ্ছে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে।
এমনকি বর্তমানে নারী-শিশু/মানব পাচার, মাদক বেচা-কেনা/পাচার, অস্ত্র চোরাচালান অসংখ্য অবৈধ কাজ ও অপরাধ তথ্য ও প্রযুক্তিকে ভিত্তি করে বা ব্যবহার করেই হয়ে থাকে।
দূর্ভাগ্যজনক বা বিপদজনক এই বাস্তবতায় নেটওয়ার্ক বা যোগাযোগের জালে যুক্ত হতে গিয়ে ইচ্ছায়-অনিচ্ছায় অনেকেই জড়িয়ে পড়ছেন বিভ্রান্তির বেড়াজালে। উঠতি বয়সী কিশোর/কিশোরীরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন বেশি।
বাংলাদেশে ডিজিটাল প্রযুক্তির ইমোশনাল ইউজ- অর্থাৎ ঘনিষ্ট ছবি ধারন, ভিডিও ধারন, অপরিচিত এ্যাপ্স এর ব্যবহার ইত্যাদির কারনে- ব্লাকমেইল করে সম্ভ্রম-হানী, যৌন-হয়রানী, ধর্ষণ ইত্যাদির মত অসংখ্য ঘটনা ঘটছে বাংলাদেশে। পরিনতিতে আত্মহত্যার পথ বেছে নিচ্ছেন অসংখ্য কিশোরী।
আমাদের পরিবার, সন্তান, প্রজন্ম ও দেশকে অনাকাংখিত সব ডিজিটাল ক্রাইম ও বিপদের হাত থেকে রক্ষা করার জন্য এখনই আমাদের সবাইকে সচেতন হতে হবে।
সাইবার নিরপত্তার জন্য করনীয় :
১। যেকোন ডিজিটাল ডিভাইস (এনড্রয়েড মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, কম্পিউটার) যাতে আমরা ইন্টারনেট ব্যবহার করবো বা যাতে কোনো এ্যাপ্স, প্রোগ্রাম, ডাউনলোড বা ইন্সটল করবো তাতে ব্যক্তিগত গোপনীয় কোন তথ্য,পাসওয়ার্ড, ব্যাংক/কার্ড ডিটেইল, অডিও, ভিডিও বা কোনো কিছু যা অপর কেউ জানতে পারলে কোনো প্রকার ক্ষতির সম্ভাবনা বিদ্যমান তা উক্ত ডিভাইসে জমা রাখা থেকে বিরত থাকুন। একান্তই জমা রাখতে হলে ইন্টারনেট এর সাথে সংযুক্ত নয় এমন কোন স্টোরেজ ডিভাইসে তা সেভ বা জমা রাখুন।
০২। ডিভাইস বা একাউন্ট ব্যবহার করাকালে কখনোই কোন Remember Password offer, Remote Access offer ইত্যাদি Accept করা যাবেনা।
০৩। যেকোন একাউন্ট ব্যবহারের ক্ষেত্রে প্রতিবার বা সব সময় উক্ত একাউন্ট থেকে লগ ইন ও লগ আউট হতে হবে। অলসতা করে লগ-আউট না হওয়ার অভ্যাস পরিত্যাগ করতে হবে।
০৪। আপনার সাথে কোন নায়ক/নায়িকার বা রাজা বা রানীর সাথে মিল আছে কিংবা ৩০ বছর পর আপনাকে কেমন দেখাবে এই জাতীয় লিংকে কখনোই প্রবেশ করা যাবেনা। কেননা এ জাতীয় লিংকগুলো তৈরিই করা হয় অপরের তথ্য চুরি, একাউন্ট হ্যাক, ডিভাইসে Unauthorise Access, Unauthorise control ইত্যাদি করার উদ্দেশে। সুতরাং এমন বোকামি করা থেকে বিরত থাকুন।
০৫। কোনো এ্যাপ্স, প্রোগ্রাম বা কোনো সুবিধা নেবার সময় আপনার ফেসবুক, ই-মেইল বা অন্য কোন একাউন্ট এর ইউজার আইডি বা পাসওয়ার্ড চায় এই ধরনের লিংকে প্রবেশ করবেন না।
০৬। অপরিচিত কোনো মেইল বা লিংকে কোনক্রমেই প্রবেশ করা যাবে না। ক্লিক করলে রিডাইরেক্ট করে এরূপ লিংক বা সাইট পরিহার করুন।
০৭। কোনো পর্ণগ্রাফিক সাইটের লিংকে ক্লিক করা বা প্রবেশ করা যাবে না। বা ফ্রি ভিডিও গেইমিং লিংকে এক্সেস করা যাবেনা। কেননা সবচেয়ে বেশী সংখ্যক ব্ল্যাক-মেইলিং, হ্যাকিং সফটওয়্যার ইন্সটলেশন এর ঘটনা ও একাউন্ট/ডিভাইস কন্ট্রোল হারানোর ঘটনা পর্ণগ্রাফিক সাইটের মাধ্যমেই বেশি হয়ে থাকে। সুতরাং এ বিষয়ে সাবধান থাকুন।
০৮। আপনার ফেইস-বুকের টাইম-লাইনের সেটিং ঠিক করতে হবে। যেখানে অন্য কেউ কিছু লিখে টাইমলাইনে যাতে না দিতে পারে সেই ব্যবস্থা করতে হবে।
০৯। যেকোন একাউন্ট খুললে তা Two factor aythentication এর মাধ্যমে খুলুন। এ কাজে ব্যবহারের জন্য প্রদত্ত ফোন নম্বরটি সম্ভব হলে অবশ্যই আলাদা একটি ফিচার ফোনে সংযুক্ত রাখুন।
১০। নিজ একাউন্ট খোলার জন্য ব্যবহৃত তথ্য সমুহ সঠিক ভাবে মনে রাখুন। সঠিক জন্ম তারিখ ও বছর উল্লেখ/সংযুক্ত করুণ (NID Birth Certificate উল্লেখিত তথ্যের অনুরূপ)। ফলে কোনো কারনে একাউন্ট এর নিয়ন্ত্রন হারালে সহজে একাউন্ট রিকভার করা সম্ভব হবে।
১১। কোনো একাউন্ট খোলার জন্য অপরের সহায়তা নিলেও পাসওয়ার্ড নিজে দিন ও মনে রাখুন। নিরাপত্তার স্বার্থে পাসওয়ার্ড মনে রাখতে না পারলে আপনার জন্য এ ধরনের একাউন্ট ব্যবহার না করাই আপনারসহ আপনার সাথে সংযুক্তদের জন্য মঙ্গলজনক। কেননা আপনার অদক্ষতা বা অজ্ঞতার কারনে আপনার সাথে কোনভাবে সম্পৃক্ত বা সম্পর্কিত ব্যক্তিগন ইচ্ছায় বা অনিচ্ছায় মারাত্মক বিপদগ্রস্থ হতে পারেন। কেননা সাইবার ক্রিমিনালগণ এ ধরনের দূর্বল ব্যবহারকারীগণের মাধ্যমেই তার টার্গেটকে এ্যাটাক বা ঘায়েল করে থাকে।
১২। মোবাইল, কম্পিউটার বা মেইলের পার্সওয়ার্ড ০৩ মাস অন্তর অন্তর পরির্বতন করতে হবে। কোন রিমোট এক্সেস অফার এক্সসেপ্ট করা থেকে বিরত থাকুন।
১৩। মোবাইল বা কম্পিউটারে কোন অন্তরঙ্গ ছবি রাখা যাবে না। এই ধরনের কাজ হতে বিরত থাকুন। কারন যেকোন সময় আপনার মোবাইল ফোনটি হারিয়ে যেতে পারে কিংবা যেকোন সময় আপনার বন্ধু-বান্ধব আপনার কম্পিউটারে প্রবেশ করে আপনার ছবি চুরি করে নিয়ে আপনাকে কিংবা আপনার প্রিয়জনকে ব্ল্যাকমেইল করতে পারে।
১৪। কোনক্রমেই লোকেশন/অবস্থান জনীত ছবি বা তথ্য আপডেট দেওয়া যাবে না। যেমন- গোপন ও বিশেষ অভিযানে …… এর উদ্দেশে রওয়ানা দিলাম, জীবনে প্রথম একাকী নানার বাড়ীর পথে, আমি সাক্ষী দিতে যাচিছ, আমি এখন ট্রেনে,বাসে ইত্যাদি।
১৫। আপনার মোবাইল বা কম্পিউটারে কিংবা মেসেঞ্জারে কোন অপরিচিত নাম্বার হতে কোন মেইল বা ছবি আসলে তা কোনক্রমেই খোলা উচিত না। বিশেষ করে স্পাম মেইল খোলা থেকে বিরত থাকুন।
১৬। কোন OTP (One time password) কাউকে শেয়ার করা বা বলা যাবেনা। বেশী বা লোভনীয় মুনাফা বা লাভ দেখালেও নয়।
১৭। আপনি লটারীতে টাকা বা গাড়ী জিতেছেন কিংবা আমেরিকা ও ইউরোপ থেকে এফবি একাউন্ট হোল্ডার কোন ব্যক্তি যদি আপনাকে মেইল করে জানায় যে, সে অনেক বড় লোকের মেয়ে তার কাছে অনেক ডলার আছে। অর্থাৎ লোভনীয় কোনো মেইলের ফাঁদে পড়া যাবে না।
১৮। কোন অপরিচিত নাম্বার হতে ফোন করে আপনার কোনো তথ্য চায় যেমন-এনআইডি নাম্বারসহ অনান্য তথ্যাদি তাহলে সেই ফোন বর্জন করতে হবে। অপরিচিত কাউকেই নিজের কোন তথ্য দেওয়া থেকে বিরত থাকুন।
১৯। কোন অপরিচিত নাম্বার হতে ফোন করে আপনাকে জানায় যে, সে রবি বা গ্রামীন ফোনের কাষ্টমার কেয়ার সেন্টার হতে ফোন করেছে তাদের সার্ভেয়ারের সমস্যার কারনে আপনার মোবাইল ফোনটি কিছু সময়ের জন্য বন্ধ রাখতে হবে; এই ধরনের কোন কথাবার্তা শোনা যাবে না। কোনক্রমেই মোবাইল ফোন বন্ধ রাখা যাবে না।
২০। কোনো অপরিচিত নাম্বার হতে মিস কল আসলে তা ব্যাক করা যাবে না। হতে পারে আপনার নাম্বার ও পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার জন্য অপরাধী চালাকি করছে।
২১। আপনার সেভ করা বা কোনো পরিচিত নাম্বার হতে কল করে অন্যায় কোন দাবি করলে বা ভয় দেখালে প্রভাবিত হয়ে কোন ভুল করে বসবেন না। হতে পারে এটি একটি স্পুফিং কল। প্রতারণার উদ্দেশে কলটি করা হয়েছে। প্রয়োজনে ঐ নাম্বারে কলব্যাক করুন। বিষয়টি পরিস্কার হয়ে যাবে।
২২। যদি কোন সফটওয়ার বা এ্যাপস এ প্রবেশের সময় আপনার তথ্য বা এক্সেস চায় তবে তা ইন্সটল না করাই শ্রেয়।
২৩। যেকোনো একাউন্ট খুলতে সব সময় শক্তিশালী পার্সওয়ার্ড, যেমন-সংখ্যা, Symbol ও অক্ষরের Mixed/Complex পার্সওয়ার্ড ব্যবহার করুন।
২৪। +০০০০, +১১১১, অথবা +২২২২ বা মেশিন জেনারেটেড এই জাতীয় ফোন নাম্বার থেকে ফোন রিসিভ থেকে বিরত থাকুন।
২৫। সাইবার বা প্রযুক্তি জগত না জেনে, না শুনে অতি আগ্রহ বা এডভেঞ্চারাস হয়ে কোন কাজ করবেন না। জেনে-বুঝে কাজ করুন। সচেতন থাকুন, নিরাপদ থাকুন।
কোন ঘটনা সংঘটনের পরে বা সাইবার এ্যাটাক বা অফেন্স এর শিকার হওয়ার পর করণীয় :
০১। কোন ব্যক্তি যদি কোন সাইবার অপরাধ বা সাইবার সংক্রান্ত কোন ক্ষতির শিকার হন তবে উক্ত ব্যক্তির উচিত হবে কবে, কখন, কোথায়, কিভাবে, কি ঘটনা ঘটেছে তা সংক্রান্ত তথ্য-প্রমানের একটি রেকর্ড সংরক্ষন করা। অর্থাৎ কোথায়, কিভাবে, কি ঘটনা ঘটেছে তার উৎস বিষয়ে পরিচয় বহন করে এরূপ তথ্যের ছবি তুলে রাখা বা ভিডিও সংরক্ষন করা (তারিখ ও সময়সহ)।
০২। ফেসবুক সংক্রান্ত ঘটনা হলে, সম্পৃক্ত একাউন্ট সমুহের প্রয়োজনীয় অংশের (একাউন্টের তথ্য ও বিতর্কিত পোষ্ট বা কাজের) স্ক্রিনশট ইউআরএল (URL) সহ গ্রহন করে সংরক্ষন করতে হবে। ল্যাপটপ বা ডেক্সটপ এর মাধ্যমে কাজটি করা গেলে ভাল। নয়ত মোবাইলের মাধ্যমে- স্ক্রিনশট নিতে হলে অবশ্যই UC browser বা অন্য কোন উপযুক্ত ব্রাউজার এর মাধ্যমে একাউন্টে এক্সেস করে প্রয়োজনীয় ইউআর এল তথ্যসমেত স্ক্রিনশট গ্রহন করে সংরক্ষন করতে হবে। কাজটি দুইজন সাক্ষীর উপস্থিতিতে করা গেলে ভাল।
০৩। WhatsApp, imo, Viber, Telegram, Instagram হলে সম্পৃক্ত একাউন্ট সমুহের পরিচিতি সংক্রান্ত তথ্য বা একাউন্টের নামসহ মোবাইল নাম্বার নোট রাখুন(সম্ভব হলে)।
০৪। ই-মেইল সংক্রান্ত ঘটনা বা অপরাধ হলে; সম্পৃক্ত ই-মেইল একাউন্ট এর ই-মেইল আইডি, মেসেজ আইডি, তারিখ ও সময় সহ প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে ছবি তুলে রাখতে হবে।
বিঃদ্রঃ কোন ঘটনার শিকার হলে দ্রুততম সময়ের মধ্যে সংশ্লিষ্ট থানায় বা আইসিটি বিষয়ক জ্ঞান রাখেন এ ধরনের মানুষের সহায়তা নিন।
“নিজে সুরক্ষিত থাকুন, আপনার পরিবারকে সুরক্ষিত রাখুন”